বাংলাদেশের পাহাড়ি সৌন্দর্যের কথা বললেই যে কয়টি স্থানের নাম সবার আগে মনে পড়ে, তার মধ্যে নিলগিরি(Nilgiri) অন্যতম। বান্দরবানের থানচি রোডের পাশে অবস্থিত এই স্বর্গীয় স্থানটি যেন প্রকৃতির হাতে আঁকা এক নিখুঁত চিত্রকর্ম। মেঘ, পাহাড় ও সূর্যের মেলবন্ধনে গঠিত নিলগিরি পর্যটকদের হৃদয় জয় করে নিয়েছে বহু আগে থেকেই।এটি বান্দরবান শহর থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত এবং সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে উচ্চতা প্রায় ২,২০০ ফুট (৬৬০ মিটার)। মেঘে ঢাকা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নিলগিরি , শীতল পরিবেশ, ও পাহাড়ের ওপরে দাঁড়িয়ে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখার অভিজ্ঞতার জন্য বিখ্যাত। এমনকি গ্রীষ্মকালেও এখানে ঠান্ডা অনুভব করা যায়। অনেকে এটিকে “বাংলাদেশের দার্জিলিং” বলে থাকেন।

নিলগিরি দেখার মতো দৃষ্টিনন্দন স্থানসমূহ:
১।মেঘের রাজ্য: নিলগিরিকে বাংলাদেশের “মেঘের রাজ্য” বলা হয় একেবারে যথার্থভাবেই। এখানে প্রকৃতি ও মেঘ একে অপরের সঙ্গে এমনভাবে মিশে থাকে যে আপনি কখনো অনুভব করবেন মেঘের ভিতর হাঁটছেন, আবার কখনো মনে হবে আকাশ যেন মাটির গায়ে নেমে এসেছে। এটি এমন একটি অভিজ্ঞতা, যা জীবনে একবার না দেখলে অপূর্ণ থেকে যায়।
২।সূর্যোদয় | Sunrise at Nilgiri: নিলগিরির ভোর শুরু হয় এক মোহনীয় সৌন্দর্যে। যতক্ষণ না সূর্য পাহাড়ের পেছন থেকে উঁকি দেয়, ততক্ষণ চারপাশে থাকে এক রহস্যময় নিস্তব্ধতা। এরপর ধীরে ধীরে আকাশের রঙ বদলাতে শুরু করে—নীলচে-সাদা থেকে কমলা, আর তারপর সোনালী।মেঘের চাদর ফুঁড়ে আসা সূর্যের আলো এক অলৌকিক দৃশ্য তৈরি করে।ভোরের হালকা ঠান্ডা বাতাস, পাখির ডাক আর কুয়াশাচ্ছন্ন মেঘ একত্রে এক আধ্যাত্মিক পরিবেশ সৃষ্টি করে।সকালের প্রথম আলো যখন পাহাড়, গাছপালা ও মেঘের উপর পড়ে, তখন নিলগিরি হয়ে ওঠে এক জ্যান্ত ক্যানভাস।

৩।সূর্যাস্ত | Sunset at Nilgiri
নিলগিরির সূর্যাস্ত এক বিষণ্ন রোমান্টিকতা মিশ্রিত মুহূর্ত। সারা দিনের আলো-ছায়ার খেলা শেষে যখন সূর্য ধীরে ধীরে পাহাড়ের আড়ালে মিলিয়ে যায়, তখন আকাশ রাঙিয়ে ওঠে নানা রঙে—কমলা, গোলাপি, লালচে-বেগুনি।সূর্য ডোবার সময় মেঘ ও আলো একসাথে এক অপরূপ দৃশ্যপট তৈরি করে।এই সময়টায় নিলগিরিতে নেমে আসে এক মায়াময় নিস্তব্ধতা ও প্রশান্তি।সূর্যাস্ত শেষে কিছুক্ষণ পরেই পাহাড়ে নেমে আসে রাতের অন্ধকার, তখন আকাশ ভরে যায় হাজারো তারা আর জোনাকির ঝিকিমিকিতে।
৪।আদিবাসী গ্রাম: কাছেই রয়েছে মুরুং, বম প্রভৃতি আদিবাসী সম্প্রদায়ের গ্রাম, যারা অতিথিপরায়ণ এবং ঐতিহ্যবাহী জীবনযাপন করে।

৫।পাহাড়ি ফুল ও গাছপালা: মৌসুমভিত্তিক নানা ধরনের পাহাড়ি ফুল ও সবুজ গাছপালার সমারোহ এখানে প্রকৃতিকে আরও জীবন্ত করে তোলে।
৬।নিলগিরিতে ফটোগ্রাফির জন্য আদর্শ সময়:
সূর্যোদয়ের সময় সোনালি আলো ফটোগ্রাফিতে ‘Golden Hour’ হিসেবে পরিচিত।পাহাড়ের ওপর দাঁড়িয়ে দূরবর্তী পাহাড়গুলোর মধ্যে সূর্য ওঠার দৃশ্য ক্যামেরাবন্দি করলে মুগ্ধকর চিত্র তৈরি হয়।
নিলগিরি থাকার ব্যবস্থা :
নিলগিরিতে রয়েছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কর্তৃক পরিচালিত রেস্ট হাউস। তবে এই রেস্ট হাউসে থাকার জন্য আগে থেকেই অনুমতি ও বুকিং নিতে হয়। বিকল্পভাবে, পর্যটকরা বান্দরবান শহরে থেকে দিনভ্রমণে নিলগিরি ঘুরে আসতে পারেন।

নিলগিরি কিভাবে যাওয়া যায়ঃ
১।ঢাকা থেকে বান্দরবান: সায়দাবাদ, কলাবাগান বা কমলাপুর থেকে বিভিন্ন বাস সার্ভিস (Soudia, Shyamoli, Unique) সরাসরি বান্দরবান যায়।.
২।বান্দরবান থেকে নিলগিরি: বান্দরবান শহর থেকে জিপ বা চাঁদের গাড়িতে প্রায় ২-৩ ঘণ্টায় পৌঁছানো যায়।
৩।রাস্তাটি আঁকাবাঁকা এবং পাহাড়ি, তাই নিরাপত্তার জন্য সেনা তত্ত্বাবধানে চলাচল করতে হয়।

নিলগিরি ভ্রমণের সেরা সময়:
১।অক্টোবর থেকে মার্চ: পরিষ্কার আকাশ, ঠান্ডা হাওয়া এবং সূর্যোদয়-সূর্যাস্ত দেখার উপযুক্ত সময়।
২।শীতকাল (নভেম্বর–ফেব্রুয়ারি): পরিষ্কার আকাশের কারণে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত স্পষ্ট দেখা যায়।
৩।বর্ষাকালে কিছুদিন আকাশ ঢাকা থাকে মেঘে, তবে মেঘের ভেদে আলো-ছায়ার খেলা হয় অত্যন্ত নাটকীয় ও ছবির মতো।
নিলগিরি ও বান্দরবানের বিখ্যাত খাবারসমূহঃ
১।বাশেঁর ভেতরে রান্না করা চিকেন (Bamboo Chicken)এটি পাহাড়ি অঞ্চলের একটি জনপ্রিয় খাবার।চিকেনকে মসলা দিয়ে বাঁশের ভেতর ভরে আগুনে সেদ্ধ করা হয়।এতে চিকেনের মধ্যে বাঁশের ঘ্রাণ মিশে এক অনন্য স্বাদ তৈরি হয়।
২।পাহাড়ি ভর্তা ও শাকসবজিপাহাড়ি মানুষদের খাদ্যতালিকায় নানা রকমের ভর্তা, যেমন বেগুন, ধনেপাতা, টক ঝাল টমেটো ইত্যাদি পাওয়া যায়।স্থানীয়ভাবে সংগৃহীত শাকসবজি ও গুল্মজাতীয় খাবার স্বাস্থ্যকর ও ভিন্ন স্বাদের হয়।
৩।চাকমা বা ম্রো আদিবাসীদের ঐতিহ্যবাহী খাবারযেমনঃ “মারফা” (শুকনো মাছ, কচু ও বেগুনের মিশ্র রান্না), নাক্কু (পানি ছাড়া রান্না করা ঝাল মাংস), এবং রিংপু চাউল (একধরনের লাল চাল)।এইসব খাবার সাধারণত ঝাল ও স্বাদে ইউনিক।

বান্দরবান শহরের রেস্টুরেন্ট ও হোটেল:
১।Hillside Resort Restaurant
২।Food Circle
৩।Restaurant Green Hill
৪।Meghla Tourist Spot Food Stallsএসব জায়গায় পাহাড়ি ও বাঙালি দুই ধরনের খাবারই পাওয়া যায়।
☛ আরও ভ্রমন গাইড পড়ুনঃ নয়নাভিরাম জলপ্রপাত মায়াবী ঝর্না
Leave a Reply